বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষা-প্রো ভিসি(শিক্ষা) ঢাবি

157

অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল

জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, সমাজ-অর্থনীতি, ইতিহাস-ধর্মচর্চা প্রভৃতির উদ্ভব, বিকাশ ও বিস্তৃতি সবকিছুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি। পৃথিবীতে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উৎপত্তি ধর্মীয় চিন্তাভাবনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘নালন্দা’। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি। বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন বিষয়, ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, দর্শনশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে এখানে জ্ঞানদান করা হতো। প্রাচীন ভারতের মগধ (বর্তমান বিহার) রাজ্যের রাজধানী রাজগীর থেকে ১০ কি.মি. দূরে অবস্থিত ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ইউরোপে গির্জা, চার্চ, তথা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক জ্ঞান-চর্চার প্রসার লাভ করে, ক্রমশ প্রাতিষ্ঠানিকতা পেতে থাকে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তিন দফায় আক্রমণের শিকার হয়ে ধ্বংস হয়ে গেলেও ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ইতালির বোলগনা ইউনিভার্সিটি (১০৮৮)। ধারণা করা হচ্ছে এটিই পৃথিবীতে সনদ প্রদানকারী প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। মধ্যযুগে প্রতিষ্ঠিত ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বস্তুত উচ্চশিক্ষার আধুনিক ভাবধারা নিয়ে আসে। যেমন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় (১০৯৬), সালামানকা বিশ্ববিদ্যালয় (১১৩৪), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় (১১৬০), ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় (১২০৯) ইত্যাদি।
শিক্ষাবিদ এন্ডু কার্নেগি তথা কার্নেগি ফাউন্ডেশন কর্তৃক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চারটি ভাগে বিভাজন করা হয়েছে। এগুলো R1- উচ্চ গবেষণাধর্মী প্রধানত মৌলিক গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন : স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়; R2- মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন : মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়; R3- প্রায়োগিক ও মৌলিক গবেষণাসম্পন্ন ডিগ্রি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন : সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং M- ডিগ্রি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো M ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত বলা যায়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় M এবং R3 ক্যাটাগরির মধ্যে অবস্থান করছে।

উন্নত দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান চরিত্র হলো বিশেষত মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণায় বিশেষ মনোনিবেশ করা এবং ইন্ডাস্ট্রি-ইউনিভার্সিটির কার্যকর সমঝোতা ও জ্ঞান ব্যবস্থাপনায় সরাসরি সমাজের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক স্থাপন।

নিও-লিবারেল (Neo-Liberal) গ্লোবালাইজেশন এবং জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির এ যুগে উচ্চশিক্ষা ও উচ্চপ্রবৃত্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর বড় দৃষ্টান্ত হলো দক্ষিণ কোরিয়া। গবেষণায় ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজারমুখী শিক্ষায় এশিয়ার মধ্যে বহুদূর এগিয়ে। এক্ষেত্রে গবেষণা-উন্নয়নে সরকারের বরাদ্দও প্রণিধানযোগ্য, যা জিডিপির ৪.৮০ শতাংশ। ১৯৮০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু আয় ছিল ১৭১৫ ডলার, ২০২১ সালে দাঁড়িয়েছে ৩৫০০০ ডলার-এ, যা যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষার ফলাফল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সিংগাপুর ও মালয়েশিয়া গত চার দশকে উচ্চশিক্ষায়, বিশেষত গবেষণায় ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে এবং আশাতিরিক্ত ফলও পেয়েছে। সিংগাপুরকে অনুসরণ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত রুয়ান্ডা উচ্চশিক্ষায় বহুদূর এগিয়ে গেছে। আজ রুয়ান্ডা আফ্রিকার সিংগাপুর নামে খ্যাত।

ইন্ডাট্রি ইউনিভার্সিটির কার্যকর সমঝোতা ব্যতীত উচ্চশিক্ষা কখনো প্রায়োগিক ও বাজারমুখী করা সম্ভব নয়। এ ধরনের সমঝোতার কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে। জাপানের প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয়কে ইনোভেশন-হাব হিসাবে চিহ্নিত করে দেশটি প্রতিটি উন্নয়ন কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সহযোগিতা নিয়ে থাকে। একজন শিক্ষার্থীকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে সম্পূর্ণ নির্ভুল গবেষণা কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়। জাপানি শিক্ষার্থী-গবেষকরা পরীক্ষাগারে পর্যাপ্ত সময় দিয়ে থাকে। যে কারণে আজ জাপানি বিশেষজ্ঞরা পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত এবং জাপানি প্রযুক্তিও অত্যন্ত সূক্ষ্মমানসম্পন্ন ও ব্যয়বহুল।

গবেষণার মাধ্যমে সৃষ্ট জ্ঞানের প্রয়োগ ও প্রভাব নিশ্চিতকরণও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় কাজ। জ্ঞান অর্থহীন, যদি এর প্রয়োগ সামাজিক উন্নয়নে কাজে না আসে। টেকসই উন্নয়নের এ সময়কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব সমাজে কতটুকু, তাও বর্তমানে নির্ণয় করা হয়। একে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইফপ্যাক্ট র‌্যাঙ্কিং বলা হয়। টাইমস্ হায়ার এডুকেশনের তথ্যমতে, এসডিজি গোলভিত্তিক ইফপ্যাক্ট র‌্যাঙ্কিংরে ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটি (অস্ট্রেলিয়া) পৃথিবীব্যাপী ২০২২ সালে শীর্ষে অবস্থান করেছে। পৃথিবীর কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফপ্যাক্ট র‌্যাঙ্কিংয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রশাসকও নিয়োগ করা হয়। যেমন : কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (ইফপ্যাক্ট) নামে একটি পদ আছে। পৃথিবীর অনেক দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতি বা পদায়ন নির্ভর করে শিক্ষকতা ও গবেষণায় তারা সমাজে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারছে তার উপর। মাস দুয়েক আগে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. রাসেল থমসন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমি ড. রাসেলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার গবেষণা প্রবন্ধ কতটি। তিনি জানালেন প্রায় ২০০টি। জানতে চাইলাম, এখনো অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি পাননি কেন? ড. রাসেল জানাল, সোসাইটিতে তার গবেষণার সরাসরি ইফপ্যাক্ট কম বিধায় পদোন্নতি বিলম্বিত হয়েছে, তবে এখন তিনি পদোন্নতির শর্ত পূরণ করেছেন।

শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষক ও শিক্ষাদানের পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি বা পদায়নের যৌক্তিকতা উচ্চশিক্ষার অনুষঙ্গী অংশ। আমি যখন ১৯৯৬ সালে নেদারল্যান্ডের ‘টুয়েন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফ্যাকাল্টি অব জিও ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যন্ড আর্থ অবজারভেশন’-এ দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রিতে অধ্যয়ন করি তখন ড. ভেনডের মীর আমাদের রিমোট সেন্সিং পড়াতেন। তিনি ১৯৯৯ সালে বত্রিশ বছর বয়সে অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি পান। তিনি অবজেক্ট নির্ণয় সংক্রান্ত রিমোট সেন্সিং গবেষণায় অসামান্য দক্ষতা দেখাতে পেরেছিলেন বিধায় পদোন্নতি পেয়েছিলেন। অথচ তার সমসাময়িক অনেকেই অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি পাননি; যাদের পদোন্নতি হয়েছে তারাও অনেক বয়সেই পেয়েছেন। রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক কারণে আমাদের দেশে পদোন্নতির এরকম নীতি অনুসরণ করা এখনো দুরূহ।

শিক্ষা-শিক্ষাদানের উন্নত পরিবেশ নিশ্চিত না করা পর্যন্ত পঠন-পাঠন ও গবেণায় স্থির মনোনিবেশ কঠিন হয়ে পড়ে। ২০১৯ সালে আমি পিকিং ইউনিভার্সিটির (বেইজিং) সেনজেন গ্র্যাজুয়েট ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম। পিনপতন নিস্তব্ধতা এবং পড়াশোনা ও গবেষণায় একাগ্রতার পরিবেশ যেভাবে এ ক্যাম্পাসে গড়ে তোলা হয়েছে, তা আমাকে বিমোহিত করেছে। মনে হয়েছে, ক্যাম্পাসটি একটি আরাধনার স্থান। বেইজিং থেকে সেনজেন প্রায় ২০০০ কি.মি. দূরে, বিশ্ববিদ্যালয়টির তৃতীয় ক্যাম্পাস। বর্তমানে টাইমস হাইয়ার এডুকেশনের র‌্যাঙ্কিংয়ে পিকিং ইউনিভার্সিটির (বেইজিং) অবস্থান বিশ্বে ১৬তম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে হাইওয়ে ও সিটি করপোরেশনের রাস্তা। প্রায় সাতটি প্রবেশ পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে যাতায়াত করা যায়। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, কোলাহল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্যসঙ্গী। তার ওপর অধিক শিক্ষার্থীর চাপ। এমতাবস্থায়, পঠন-পাঠনে ও গবেষণায় স্থির মনোনিবেশের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়টির পারিপার্শ্বিকতা আজকের বাস্তবতায় কতটুকু উপযোগী, তা ভাবা দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষকে সামনে রেখে গবেষণার ইকোসিস্টেম উন্নয়ন, শিক্ষার্থী সংখ্যা বাস্তব ও যুক্তিসঙ্গত করা, অবকাঠামোগত ও একাডেমিক মাস্টার প্ল্যান প্রস্তুতকরণ, জার্নালগুলোর মানোন্নয়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পদোন্নতির নীতিমালা সংস্কার, শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক মূল্যায়ন, কারিকুলাম যুগোপযোগী ও আধুনীকরণসহ বহু পরিকল্পনা আমরা হাতে নিয়েছি। উচ্চশিক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তন আনতে হলে অ্যালামনাইদের সামগ্রিক সহযোগিতা যেমন একান্ত প্রয়োজন, তেমনি গুণগত শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে রাজনৈতিক দলগুলোকেও সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষায় পরিবর্তন আনা সম্ভব হলে, দেশের অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও পরিবর্তনের প্রক্রিয়া সহজতর হবে। এখানে উল্লেখ্য, এসব কারণে বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষাকে টপ-ডাউন-এপ্রোচ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

লেখক : উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই লেখাটি সম্পর্কে আপনার মতামত জানাতে পারেন।

  • Facebook Comments